শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০৪:১৮ অপরাহ্ন
আবদুল আজিজ
লকডাউনে আইনশৃংখলা বাহিনীর ব্যস্ততার সুযোগে সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসছে ইয়াবার চালান। প্রতিদিন বানের স্রোতের মত আসছে ইয়াবা। ইতিমধ্যে বেশকিছু ইয়াবার চালান আইনশৃংখলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা জব্দ করলেও বেশিরভাগ ইয়াবা পাচার হয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সম্প্রতি টেকনাফ সাবরাং মুন্ডার ডেইলঘাটস্থ সমুদ্র সৈকত থেকে খালাসের সময় ইয়াবার বিশাল একটি চালান লুটের ঘটনায় এখনও কোন ক্রু উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
দেশে ইয়াবা পাচারের প্রধান ট্রানজিট পয়েন্ট হচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা। দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তবর্তী ৩০টিরও বেশী পয়েন্ট দিয়ে পাচার হয়ে আসছে ইয়াবার চালান। এসব পয়েন্টে দেড় হাজারেরও বেশী লোক ইয়াবাকারবারের সঙ্গে জড়িত। একারণে এসব ইয়াবাকারবারিদের চিহ্নিত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ইয়াবাকারবারি ও গডফাদারদের তালিকা প্রকাশ করে। এই তালিকায় কিছু কিছু কারবারি পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও বিভিন্ন আইনশৃংখলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হলেও আত্মসমর্পণের নামে বেশিরভাগ ইয়াবাকারবারি রয়ে যায়। এসব ইয়াবাকারবারিরা জামিনে বের হয়ে পুনরায় ইয়াবাকারবারে ফিরেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউতে গত ১৪ এপ্রিল লকডাউন ঘোষনার পর কক্সবাজারের জেলা পুলিশ, র্যাব ও বিভিন্ন আইনশৃংখলা বাহিনী নানাকাজে ব্যস্থতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইয়াবা পাচারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে কারবারিরা। একারণে প্রতিদিন সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে বানের স্্েরাতের মত আসছে ইয়াবার চালান। যেন সীমান্তে ইয়াবার স্রোত।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১৪ এপ্রিল লকডাউনের পর আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে কোটি টাকার ইয়াবার। পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে ১৭ এপ্রিল ইয়াবাপাচারের সময় চকরিয়া থানা পুলিশ রোহিঙ্গা যুবকের পেট অপারেশন করে ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা মূল্যের ইয়াবা উদ্ধার করে পুলিশ। একইভাবে গত ২১ এপ্রিল উখিয়া থানা পুলিশ ইয়াবাসহ ৪ জন কারবারিকে আটক করে। ২২ এপ্রিল উখিয়ার শীর্ষ ইয়াবাকারবারি আলী আকবরকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। ২৩ এপ্রিল টেকনাফ শাহপরীরদ্বীপ মিস্ত্রিপাড়া থেকে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা সহ তিনজন চোরাকারবারিকে গ্রেপ্তার করে বিজিবি। একইদিন ৭ হাজার পিস ইয়াবা ও নগদ টাকা সহ নারী ইয়াবাকারবারিকে গ্রেপ্তার করে উখিয়া থানা পুলিশ। ২৫ এপ্রিল ইয়াবাসহ উখিয়া থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় দুই ইয়াবাকারবারি। সবচেয়ে বেশী ইয়াবা উদ্ধার হয় গত ২৮ এপ্রিল। এদিন টেকনাফের উনছিপ্রাং থেকে বিজিবির সদস্যরা ৪০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। একইদিন উখিয়া থানা পুলিশ নারীসহ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় উখিয়া উপজেলার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ইয়াবা সহ ৩জন। কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিসের কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে সেন্ট্রাল হসপিটালের কর্মচারিকে আটক করে। টেকনাফ থানা পুলিশ ইয়াবাসহ দুইজন অটোরিক্সা চালককে ইয়াবাসহ এবং উখিয়া থানা পুলিশ ৭ হাজার পিস ইয়াবা এক যুবককে গ্রেপ্তার করে। গত ২ মে সবচেয়ে বেশী ইয়াবার চালান উদ্ধার করে সীমান্তরক্ষী বিজিবি। এদিন টেকনাফের চৌধুরীপাড়া চিতা পয়েন্টে অভিযান পরিচালনা করে আড়াই লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে।
এদিকে ইয়াবাকারবারিদের পাশাপাশি কিছু অসাধু আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও ইয়াবাকারবারে জড়িয়ে পড়ছে। গত ২২ এপ্রিল রাতে উখিয়ায় ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হন এপিবিএন’র তিন সদস্য গ্রেপ্তার করা হয়। এরা হলেন, উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত ৮নং এপিবিএনের এসআই সোহাগ, কনষ্টেবল মিরাজ ও কনষ্টেবল নাজিম।
সীমান্তে উদ্বেগজনক হারে ইয়াবা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আইনশৃংখলা বাহিনীর খামখেয়ালিপনায় বেড়েছে ইয়াবা পাচার। প্রতিদিন মিয়ানমার সীমান্তের অর্ধশতাধিক পয়েন্ট দিয়ে বানের স্রোতের মত আসছে ইয়াবা। শুধু স্থলপথ নয় সমুদ্রপথেও আসছে ইয়াবার বড় চালান। এসব ইয়াবা চালান মাঝেমধ্যে আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও ইয়াবার বড় চালান গুলো কৌশলে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর চৌধুরী আক্ষেপ করে কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, ‘ইয়াবাকারবার এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এসব এখন বলে কোন লাভ নেই। সম্প্রতি সীমান্তে যে হারে ইয়াবা আসছে এতে মনে হয় বাঁধা দেয়ার মত কোন লোক নেই। টেকনাফে থেকে আত্মসমর্পণকারি ইয়াবাকারবারিরা জামিনে মুক্ত হয়ে অধিকাংশ কারবারি তাদের পুরনো পেশায় ফিরেছে। তারা নতুন করে জড়িয়ে পড়ছে ইয়াবাকারবারে। তারা দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও তাদের ইয়াবাকারবার চলমান ছিল। তবে বের হয়ে পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে সীমান্তে অবৈধ ব্যবসা।’
টেকনাফের উনছিপ্রাং এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় সিনিয়র সাংবাদিক তাহের নঈম কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে ইয়াবাপাচার। সীমান্তে নিয়োজিত সীমান্ত বাহিনী থেকে শুরু কওে পুলিশ, র্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ইয়াবা আসছে বানের স্রোতের মত। বিশেষ করে মেজর সিনহা হত্যাকান্ডের পর পুলিশের অভিযান শিথিল ও আত্মসমর্পণকারি ও বিদেশ ফেরত কারবারিরা এলাকায় ফিরে এসে কোমর বেঁধে নেমেছে ইয়াবাকারবারে। ইয়াবাপাচাররোধে নাফনদীতে মাছ থাকার পরও কিভাবে ইয়াবা আসছে তা ভাবিয়ে তুলেছে সীমান্তবাসিকে।’
কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক সোমেন মন্ডল কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘মিয়ানমার সীমান্ত ইয়াবাপাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট এটি দীর্ঘদিনের। কিছুদিন ইয়াবাপাচার ঝিমিয়ে থাকলেও বর্তমান সময়ে এসে ব্যাপকহারে বেড়েছে। এজন্য আমাদের আরও সক্রিয় হওয়া দরকার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জনবল সংকট হলেও আমরা বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করে বেশ কিছু ইয়াবা জব্দ করেছি। আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।’
ইয়াবারপাচারের কাজে কক্সবাজারের কুরিয়ার সার্ভিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘কুরিয়ার সার্ভিস সমুহতে সঠিক মনিটরিং ও জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এজন্য করিয়ার সার্ভিস ব্যবহারকারি গ্রাহকদের এনআইডি কার্ডের ফটোকপি, ডাটাবেজ সংরক্ষণ, ছবি, স্ক্যানিং, প্রতিদিন সংশিষ্ট আইনশৃংখলা বাহিনীর মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে ইয়াবাপাচারকাজে স্থানীয় নারী-পুরুষ শরীরের বিশেষ কায়দায় পাচার, যানবাহন সহ নানা কৌশলে ইয়াবাবহনের কারণে পাচাররোধ কঠিন হয়ে পড়েছে। ইয়াবা পাচাররোধে জনসচেনতার কোন বিকল্প নেই।’
জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: রফিকুল ইসলাম কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘চোরকারিরা তো সবসময় সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। সেই সাথে পুলিশ সহ আইনশৃংখলা বাহিনীও তৎপর। একারণে এসব ইয়াবাকারবারিরা প্রতিদিন ইয়াবা সহ ধরাও পড়ছে পুলিশের হাতে। আত্মসমর্পকারিরা জামিনে মুক্ত হয়ে পুনরায় ইয়াবাকারবারে জড়িয়ে পড়ছে কিনা তা কড়া নজরধারিতে রয়েছে পুলিশ। তাই, এসব কারবারিদের ধরতে সব সময় পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
এদিকে সম্প্রতি টেকনাফ উপজেলায় সাবরাং মুন্ডার ডেইল ঘাট পয়েন্টে প্রায় অর্ধকোটি টাকা মুল্যেও দুই বস্তা ইয়াবা লুটের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় জেলেদের ভাষ্য অনুযায়ী, দীর্ঘদিন ধরে একটি সিন্ডিকেট ওই ঘাট দিয়ে নিয়মিত ফিশিং বোটে করে মাছ শিকারের আড়ালে ইয়াবা ট্যাবলেট পাচার করে আসছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মিয়ানমার হতে ইয়াবার একটি বড় চালান আসার সংবাদে স্থানীয় আইনশৃংখলা বাহিনী কৌশলে অবস্থান নেয়। পরে আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে ভিন্ন পথ অবলম্বন করে ইয়াবার চালানটি খালাসের সময় লুটপাটের ঘটনা ঘটে। মূলত ইয়াবার বড় চালানটির মালিক শাহপরীরদ্বীপ দক্ষিণ পাড়ার নুরুল হাকিম মাঝির ছেলে জাফর আলমের। তবে এ চালানের খালাস ও নিরাপদ স্থানের পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব ছিল সাবরাং ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডেও মেম্বার মোয়াজ্জেম হোসেন দানুর। কিন্তু, ইয়াবার লুটের ঘটনায় জড়িত ওই এলাকার ইব্রাহীম, আব্দুর রহিম, ফজলুর রহমান প্রকাশ ফজরানসহ বেশকয়েকজন লুটকারী চক্র জড়িত ছিল। ওইদিন মিয়ানমার থেকে ফিশিং বোটে করে ইয়াবার বড় চালানটি নিয়ে আসে আনোয়ার মাঝির নেতৃত্বে মোঃ আলম, কাদির ও রশিদ উল্লাহ। উক্ত ইয়াবা চালান লুটের ঘটনার পর থেকে স্থানীয় পুলিশ, বিজিবি সহ বিভিন্ন আইনশৃংখলা বাহিনী তৎপর হলেও পরবর্তীতে ঝিমিয়ে পড়ে। লুটের বিষয়টি এখন পর্যন্ত কোন ধরণের ক্রু বের করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন।
ভয়েস/আআ